সুদেষ্ণা মন্ডল :: সংবাদ প্রবাহ :: ডায়মন্ডহারবার :: মঙ্গলবার ১,অক্টোবর :: জমিদারি আর নেই । কালের নিয়মে উঠে গিয়েছে জমিদারি রাজ পাঠ। কিন্তু রয়ে গিয়েছে জমিদারি আমলের বৈঠকখানা, ঘর দালান থেকে শুরু করে জমিদারি আমলের লোহার সিন্দুক।কালের নিয়মে জমিদারি প্রথার অবসানের সঙ্গে সিংহদুয়ারে দারোয়ানও আজ নেই ৷ মণ্ডলদের জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় জন্মাষ্টমীর দিন থেকে ৷
ওইদিন গঙ্গা মাটি দিয়ে দেবীর কাঠামোর পুজো হয় ৷ মহালয়ার আগে কাঠামোতে খড় বাঁধা, মাটি দেওয়া-সহ সব কাজ শেষ করে ফেলা হয় ৷ মহালয়ার দিন দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হয় ৷ নিয়ম মেনে এই প্রথা চলে আসছে ৷ এই মণ্ডল বাড়ির পুজোয় বংশ-পরম্পরায় প্রতিমা তৈরি করে আসছেন মৃৎ শিল্পীরা ৷ ঢাকিরাও বংশ পরম্পরায় ঢাক বাজান এই পুজোতে ৷ পুরোহিতের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চলে আসছে ৷
তৎকালীন বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ ৷ অবিভক্ত বাংলার নবাব থাকাকালীন লবণ ও তাঁতের ব্যবসার রমরমা ছিল ৷ ডায়মন্ডহারবার শহরের নাম ছিল তৎকালীন হাজিপুর। বারদ্রোণ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন অযোধ্যা রাম মণ্ডল ৷ তিনি ওই লবণ ও তাঁতের ব্যবসা করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হন ৷
ব্যবসার টাকায় বারদ্রোণ, মন্দিরবাজার, ঘটকপুর, হটুগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা, রায়দিঘি, মথুরাপুর, নামখানা-সহ একাধিক এলাকায় জমিদারি শুরু করেন ৷ সেই অযোধ্যা রামের বংশধর ছিলেন জমিদার গোলকচন্দ্র মণ্ডল ৷ তিনিই ১৮৬৬ সালে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন ৷১৮৬৬ সালে ডায়মন্ডহারবারের তৎকালীন হাজিপুরের বারদ্রোণ গ্রামের দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন জমিদার গোলকচন্দ্র মণ্ডল ৷
এ বছর সেই পুজো ১৫৯বছরে পড়ল ৷ আগের মতো জাঁকজমক না হলেও, নিয়ম মেনে দেবীর আরাধনা করেন মণ্ডল বাড়ির সদস্যরা ৷ বিশুদ্ধ নন্দীকেশ্বর রীতি মেনে পুজো হয় দেবী দুর্গার ৷ আগে এই পুজোয় নবমীতে পাঁঠা বলি এবং অষ্টমীর সন্ধি পুজোয় গুলি ছোড়ার রীতি ছিল ৷ জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির সঙ্গেই সেই সব রীতিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷
বারদ্রোণের জমিদার বাড়িতে সুবিশাল দালান বাড়ি তৈরি করেন তিনি ৷ অতীতে মণ্ডলদের জমিদার বাড়িতে পুজোর ৪দিন গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য কবি গানের আসর বসত ৷ মহাসপ্তমীতে এলাকায় ব্রাহ্মণ ভোজন ও মহানবমীতে কুমারী পুজোর চল ছিল ৷ কুমারী পুজো হলেও, বন্ধ হয়ে গিয়েছে ব্রাহ্মণ ভোজনের রীতি ৷
জমিদারি থাকাকালীন মহানবমীতে পাঁঠা বলির রেওয়াজ ছিল ৷ আর প্রতিদিনই গ্রামবাসীদের ভোজনের ব্যবস্থা করা হত জমিদার বাড়িতে ৷ জমিদার বাড়ির সামনে সুবিশাল সিংহদুয়ার রয়েছে ৷ জমিদারি প্রথায় সেই সিংহদুয়ারে দিনরাত পাহারায় থাকতেন দু’জন দারোয়ান ৷ জানা যায়, সেই সময় বন্দুকের গুলির আওয়াজে শুরু হত সন্ধিপুজো ৷ বর্তমানে সেই প্রথাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷
ঘরের পুরু দেওয়ালে ছিল রকমারি সব কারুকাজ । সমগ্র বাড়িতে ছিল ৩৩ টি কক্ষ । দারোয়ান, জমিদারের পালকি বাহকদের জন্যও আলাদা ঘরের ব্যবস্থা ছিল । কাছারিবাড়ির মূল প্রবেশপথের উঁচু তোরণের উপরে দু’পাশে মুখোমুখি দুটি সিংহমূর্তি । আর ফটকের ঠিক উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি ।
সদর দরজার পূর্বদিকে লম্বা বারান্দা । জমিদারের কাছারিবাড়িতে ঢোকার মূল ফটকের দু’দিকে থাকত গাদা বন্দুকধারী দুই দারোয়ান । জমিদার বাড়িতে টাকাপয়সা ও সোনাদানা রাখার জন্য ছিল বড় বড় চারটি লোহার সিন্দুক । ওই সিন্দুকের পাশে রাখা থাকত কাতান । ডাকাতির সময় যাতে ওই কাতান সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারা যায় । সে এক রূপকথার গল্প । আজও জমিদার বাড়ির সেসব চিহ্নের কিছু কিছু অবশিষ্ট রয়েছে ।