কেমন মানুষ ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ? তাঁর ১০৪ তম জন্মদিবসে জানাই শ্রদ্ধা ও প্রণাম।

নিজস্ব সংবাদদাতা :: সংবাদ প্রবাহ :: কোলকাতা :: সোমবার ১৭,জুন :: অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বম্বে যাচ্ছেন প্রথম বার, ট্রেনে। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ট্রেন লেট অনেকটাই। বম্বে পুরো অপরিচিত শহর। কাউকে চেনেন না। কী করবেন, ঠিক করতে পারছেন না। ট্রেন ঢুকল স্টেশনে। জানালা দিয়ে দেখলেন প্লাটফর্মে ছাতা মাথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এক লহমায় মুশকিল আসান !

💝 গুলজার বাড়ি কিনবেন ভাবছেন। কিন্তু হাতে তেমন টাকাপয়সা নেই। গুলজারকে কিচ্ছু জানতে না দিয়ে পেমেন্ট করলেন হেমন্ত। বাকরুদ্ধ গুলজার !

💝 শ্যামল মিত্রের বড়ো ছেলে সৈকত-এর বিয়ে। সাতসকালে হাজির দীর্ঘকায় মানুষটি। “ওর বাবা নেই, আমি না গেলে দেখাশোনা করবে কে ?” ভাবা যায় আজকের দিনে ?

💝 মান্না দে গান গাইবেন কলকাতার এক জলসায়। হঠাৎ গলা বসে গেল। গাওয়ার উপায় নেই। উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত ! অত্যন্ত কুন্ঠিত হেমন্ত বললেন- “মান্নাবাবুর জায়গায় আমাকে দিয়ে চলবে কী ? গলা ঠিক হলে ওনাকে না হয় অন্য সময় নিয়ে যাবেন।” উদ্যোক্তারা আপ্লুত। কৃতজ্ঞ মান্না দে !

💝 সতীনাথ মুখোপাধ্যায় অসুস্থ। দেখা করতে গেছেন হেমন্ত। অনেকক্ষণ গল্পের পর হেমন্ত বিদায় নিলে বালিশের তলায় উৎপলা আবিষ্কার করলেন টাকা ভর্তি একটা খাম !

💝 কলকাতায় অনুষ্ঠান শেষে নিজের গাড়ির দিকে চলেছেন হেমন্ত। রাস্তার দুপাশে জানালা দিয়ে মেয়েরা তাঁকে দেখছেন। পিছন থেকে এক বৃদ্ধা বলে ওঠেন- “কই, হেমন্ত কই ?” সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে গিয়ে করজোড়ে প্রণাম করে হেমন্ত বললেন- “এই তো আমি।” বৃদ্ধা আলোড়িত !

💝 কলেজ ফাংশনে গেছেন। সঙ্গে উৎপলা, হৈমন্তী, প্রতিমা। অনুষ্ঠান শেষে গাড়িতে উঠে খাম খুলে দেখেন, তাতে রয়েছে একেবারেই অল্প কিছু টাকা আর একটা চিরকুট। তাতে লেখা- “এর চাইতে বেশি আর জোগাড় করা যায়নি।” দেখেই ক্ষেপে গেলেন উৎপলা। বললেন- “চলুন তো, একটা হেস্তনেস্ত করে আসি। এইভাবে ঠকাবে ?” উৎপলাকে ঠান্ডা করে হেমন্ত বললেন- “ছেড়ে দে। এত টাকা কীভাবে দেবে বাচ্চাগুলো ? চল, এই টাকায় তেলেভাজা খেয়ে ব্যাপারটা সেলিব্রেট করি।” তাই করেও ছিলেন।

💝 “ভালোবাসা ভালোবাসা” ছবির কাজ চলছে। গলা ঠিক নেই। নিজেই চলে গেলেন বিরাটিতে, তুলে নিয়ে এলেন অখ্যাত শিবাজী চট্টোপাধ্যায়কে। সুপারহিট হলো গান। বিখ্যাত হলেন শিবাজী !

💝 কলকাতায় মেহেদী হাসানের অনুষ্ঠান। হাঁকডাক করে ব্যবস্থাপনায় হেমন্ত। মুগ্ধ হয়ে সেই গলার তারিফ করলেন মেহেদী হাসান !

💝 মহানায়কের লিপে হেমন্তের গান শুনে এক মহিলা দর্শক বলেছিলেন- “ইচ্ছা করছে, গলাটা কামড়ে খেয়ে  ফেলি !” হ্যাঁ, এতটাই ছিল সেই মানুষটার আবেদন !

💝 বিখ্যাত এক সঙ্গীত পরিচালক মারা গেছেন। তাঁর পরিবারের সাহায্যার্থে অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তারা হেমন্তের কাছে এসেছেন। তিনি পারিশ্রমিক আর বম্বের যাতায়াত ভাড়া দাবি করলেন। রাজী হলেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু আড়ালে হেমন্তের নিন্দা করতে ছাড়লেন না। অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চে উঠে হেমন্ত বললেন- “এখানে বৌদি (প্রয়াত সুরকারের স্ত্রী) আছেন কী ? আপনি দয়া করে এগিয়ে আসুন। আমি জানি এই সব অনুষ্ঠানে, যাঁর জন্যে এই অনুষ্ঠান, তাঁদের হাতে বিশেষ কিছু পৌঁছায় না। আমি চাই অন্ততঃ এই টাকাটা বৌদির হাতে যাক।” এই কথা বলে পুরো প্যাকেটটা তুলে দিলেন প্রয়াত সুরকারের স্ত্রীর হাতে। এতক্ষণে উদ্যোক্তারা বুঝতে পারলেন, ইনিই আসল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় !

💝 একটা অনুষ্ঠানে ১৭/১৮টা গান গেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এক বৃদ্ধার সামনে পড়লেন হেমন্ত। বৃদ্ধা তাঁর হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন- “বাবা, আমি বনগাঁ থেকে আসছি। এই নাড়ুগুলো তুমি খেয়ো। তুমি এতগুলো গান গাইলে, কিন্তু আমার সবচাইতে প্রিয় গানটা তুমি গাইলে না।” হেমন্ত বললেন-“কোন্‌ গানটা, মা ?” বৃদ্ধা বললেন- “বিষ্ণুপ্রিয়া গো, আমি চলে যাই।” হেমন্ত বললেন- “আপনি একটু বসুন, মা।” একথা বলে আবার মঞ্চে উঠে পরবর্তী শিল্পী সম্ভবতঃ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কানে কী সব বলে মাইক্রোফোনে বলেন- “এখানে আমার এক মা এসেছেন। তিনি একটা গান শুনতে চেয়েছেন। সেই গানটা করেই আমি নেমে যাব।” একথা বলে হাতের নাড়ুর ঠোঙাটি মাথায় ঠেকিয়ে সমস্ত ঘটনাটা দর্শকদের বলে বললেন- “বলুন তো, আমি কী এত ভালোবাসার যোগ্য ?” একথা বলে গানটা শুরু করেন। দু’চোখ জলে ভাসছে। গান গাইছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় !

এত ভালোবাসা, এত শ্রদ্ধা, এত সম্ভ্রম- আর কোনো গায়ক বা গায়িকা অতীতে পেয়েছেন বা ভবিষ্যতে পাবেন বলে মনে হয় না। তাই নির্বিকার চিত্তে ‘পদ্মশ্রী’ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সত্যিই তো, ‘ভারতরত্ন’ যাঁর জন্যে যথেষ্ট নয়, ‘পদ্মশ্রী’ নিয়ে তিনি কী করবেন ?

আর তাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকবেন- অনন্তকাল !
কান পেতে শুনুন- স্বর্গের নন্দন কাননে শোনা যাচ্ছে সেই রাজকীয় কন্ঠ : “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে ……..” ! 🎶

আজ মহান সংগীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনে অজানা কিছু কাহিনী স্মরণ করে
সং গৃ হী ত . . .

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − 4 =