কোটা সংস্কার আন্দোলন: বাংলাদেশজুড়ে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ–গুলি, নিহত ২৭

ব্যুরো নিউজ :: সংবাদ প্রবাহ :: কলকাতা :: শনিবার ২০,জুলাই :: কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ সারা দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় গতকাল দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ২৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার।

কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, আবার কোথাও সরকার–সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়।

দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর বুধবার রাতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। ‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি ঘোষণা করেন তাঁরা। এর সমর্থনে গতকাল দলে দলে রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা।

কোটা সংস্কারের দাবিতে এবার আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুন। বিরতি দিয়ে জুন মাসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর টানা আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। এটি চলে মূলত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর মঙ্গলবার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। এদিন হামলা-সংঘর্ষে সারা দেশে নিহত হন ছয়জন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। তবে বুধবার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীরা মেনে নেননি। এর আগে মঙ্গলবার সব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ করা হয় সিটি করপোরেশন এলাকার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ও।

গতকাল সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের সময় সংঘাত–সংঘর্ষে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাজধানীর মানুষ। বিভিন্ন এলাকায় সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, পরিবহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। ঢাকার সড়কে সকালের দিকে কিছু পরিবহন থাকলেও দুপুরের পর ফাঁকা হতে থাকে সব সড়ক। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১১টায় ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলছিল।

গতকাল সারা দেশে নিহতদের অনেকে শিক্ষার্থী। তাঁদের শরীরে গুলির চিহ্ন এবং কারও কারও মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় মারা গেছেন একজন সাংবাদিক। একই এলাকায় মারা গেছেন আরও পাঁচজন। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী গুলির আঘাতে মারা গেছে ধানমন্ডি এলাকায়।

সকালে উত্তরা এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করতে গেলে আন্দোলনকারীদের বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর শুরু হয় সংঘর্ষ, যা চলে দিনভর। এতে রাজধানীর উত্তরার তিনটি হাসপাতাল থেকে ১১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। রামপুরায় একজন ও আজিমপুরে একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া গত বুধবার রাজধানীর দনিয়া এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ইমরান বাবুর্চি (২৬)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মারা যান তিনি। এদিকে গতকাল রাত ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রামপুরার ফরাজী হাসপাতালে আরও কয়েকজনের লাশ এসেছে। তবে তাঁদের পরিচয় জানা যায়নি।

আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি সংঘাত-সংঘর্ষে আহত হয়েছেন সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পথচারী ও সরকার-সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঢাকার বাইরে সংঘর্ষে সহস্রাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঢাকায় এই সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

১০ জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ছয় জেলায় সরকারি কার্যালয়, থানা এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা-সংঘর্ষে ৩১ জেলায় পুলিশ-ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংঘর্ষে ১ হাজার ১১১ জন আহত হয়েছেন। ২৭ জনের মধ্যে ছয় জেলায় নিহত হয়েছেন আটজন। এ ছাড়া ২৪৭ জনকে আটকের খবর পাওয়া গেছে।

ঢাকার বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্র
বিক্ষোভ দমাতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। লাঠিসোঁটা নিয়ে অনেক জায়গায় ছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। লাঠিসোঁটা নিয়ে নামেন আন্দোলনকারীরাও। দুপুর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বড় সংঘাতের খবর আসতে থাকে।

রাজধানীর উত্তরা, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, ধানমন্ডি, মিরপুর, নীলক্ষেত, আজিমপুর, তেজগাঁও, শান্তিনগর, মহাখালী, শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। দিনভর এসব এলাকা ছিল রণক্ষেত্রের মতো। একপর্যায়ে মেরুল বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির মধ্যে আশ্রয় নেন পুলিশের সদস্যরা। বিকেলে তাঁদের হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করা হয়। সন্ধ্যার সময়ও বিভিন্ন জায়গায় ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।

কয়েক দফায় হামলা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন বিটিভির কার্যালয়ে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে এখানে। সন্ধ্যা সাতটায় বন্ধ হয় বিটিভির সম্প্রচার। সেতু ভবন, দুর্যোগ ভবন, বিভিন্ন পুলিশ স্থাপনা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় হামলার খবর পাওয়া গেছে।

রাজধানীজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জন মারা গেছেন। গতকাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আহত ১২০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেকে চিকিৎসা নেন বলে জানা গেছে।

জেলায় জেলায় সংঘর্ষ
চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লার শহরের কোটবাড়ী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে চট্টগ্রামে ২ জন নিহত ও ৬৩ জন আহত হয়েছেন। কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ, হামলা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে সাত জেলায় অন্তত ৩১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ২০২ জনকে আটক করা হয়।

বরিশাল সদর, পটুয়াখালীর দুমকি ও বাউফল, জামালপুর সদর, নেত্রকোনার মদন, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী সদর ও সৈয়দপুর এবং লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ ৩২০ জন আহত হন।

রাজশাহীর বাগমারা, নাটোর সদর, পাবনা সদর, জয়পুরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জ ও বগুড়ায় কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষ হয়েছে। কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হামলা চালিয়েছেন। এতে পুলিশের ১৬ সদস্যসহ ৩৭৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বগুড়ায় ৩২ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় নাটোরে ১০, পাবনায় ১৫ ও মৌলভীবাজারে কয়েকজন আটক হয়েছেন।

ঢাকার বাইরে বিক্ষোভ, হামলা
ঢাকার বাইরে অবরোধ ঘিরে সংঘর্ষের জেরে বিভিন্ন স্থাপনায় তাণ্ডব চালিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সাতক্ষীরা সদর, ময়মনসিংহের ফুলপুর, মাদারীপুর শহর, রংপুর, বগুড়া শহর ও হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, থানা, সরকারি কার্যালয় এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

হবিগঞ্জ শহরে পুলিশের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রায় চার ঘণ্টার সংঘর্ষে পুলিশের ১৬ সদস্যসহ দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চোখে গুলিবিদ্ধ একজনকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

কুষ্টিয়া, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে পুলিশের ২ সদস্যসহ অন্তত ৪১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী জোয়ারদারের গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরায় থানা ঘেরাওয়ের সময় ১৫ জনকে আটক করে পুলিশ।

যশোরের কেশবপুরে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, রাজবাড়ীতে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী-ফরিদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঝালকাঠির রাজাপুরে খুলনা-বরিশাল মহাসড়ক, গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বরিশালে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক, পঞ্চগড় শহরে পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়ক এবং কক্সবাজারে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক এবং রাঙামাটি ও লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। সংবাদ ও চিত্র সৌজন্য :: প্রথম আলো ,বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 + nineteen =