দিল্লিতে কৃষক রুখতে যেন ‘যুদ্ধপ্রস্তুতি’ শুরু !

কুমার পঙ্কজ :: সংবাদ প্রবাহ টিভি :: ৪ঠা ফেব্রুয়ারী :: নয়াদিল্লি ::

দিল্লিতে ‘যুদ্ধপ্রস্তুতি’

সাজ সাজ রব পড়ে

গেছে  রাজধানী দিল্লির সীমান্তে, বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে যেখানে ৭২ দিন ধরে প্রধানত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাখন্ড ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কৃষকেরা অবস্থান করছেন।

গত ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের অবাঞ্ছিত অশান্তি ব্যতিক্রম ধরলে এত দিন ধরে চলা এই অবস্থান নির্ভেজাল শান্তিপূর্ণ। আন্দোলন অশান্ত হলে সরকারের যে সুবিধা হয়, সেই বোধবুদ্ধি নেতাদের আছে। ২৬ জানুয়ারিতেও ছিল। দিল্লি পুলিশকে তাই আগাম সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষকদের একাংশের হিংসাত্মক হয়ে ওঠা নেতাদের শিক্ষিত করে তুলেছে। ফলে শান্ত থাকা ও শান্তি রাখার চেষ্টায় কোনো ঘাটতি নেই। তবু দিল্লি পুলিশ যা করেছে এবং করছে, তাতে ভ্রম হয়, সিংঘু, টিকরি কিংবা গাজিপুর সীমান্ত কাশ্মীর বা লাদাখে কি না!

পুলিশি প্রস্তুতির বিবরণ একটু দেওয়া যাক। অবস্থানের জায়গার সামনে সড়কের ওপর ও আশপাশে কাটা হয়েছে ট্রেঞ্চ। তোলা হয়েছে উঁচু কংক্রিটের পাঁচিল। তার ওপর লটকানো হয়েছে ‘কনসারটিনা কয়েল’ বা কাঁটাতারের গোলাকার বৃত্ত। ট্রাক্টর নিয়ে কৃষকেরা যাতে দিল্লি অভিমুখে এগোতে না পারেন, সে জন্য গড়া হয়েছে একাধিক ব্যারিকেড।

রাস্তা কেটে কংক্রিটের ঢালাইয়ের ওপর সারি দিয়ে বসানো হয়েছে লোহার ছুঁচালো গজাল ও বড় বড় পেরেক, যাতে ট্রাক্টরের চাকা ফুটো হয়ে যায়। এসবের বাইরে মোতায়েন শত শত পুলিশ, যাঁদের শরীর মোড়া আধুনিক বর্মে, এ যুগে যার পোশাকি নাম ‘রায়ট গিয়ার’। কৃষক তো দূরের কথা, প্রস্তুতি এমন, যাতে মাছিও না গলতে পারে!

দিল্লি পুলিশ এখানেই থেমে নেই। ড্রোন মারফত কৃষকদের গতিবিধির দিকে ২৪ ঘণ্টা নজরদারির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কেটে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ-সংযোগ। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এক দিন-দুই দিন করে সেই মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। বিজেপিশাসিত হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলোকে সেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হচ্ছে। বিরোধীরা ক্ষুব্ধ।

সরকারকে কটাক্ষ করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর টুইট, ‘দেয়াল না তুলে সেতু তৈরি করুন’। তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কার বিস্ময়কর প্রশ্ন, ‘প্রধানমন্ত্রীজি, শেষ পর্যন্ত নিজেদের কৃষকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন?’ সংসদ উত্তাল ও অচল। কৃষক আন্দোলন নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিতর্কে রাজি হলেও সরকারের কাছে বেশি জরুরি রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা! গণতন্ত্র গরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা কতখানি গণতান্ত্রিক ও স্বাস্থ্যকর? প্রশ্নটা উঠে গেছে।

দিল্লির পুলিশ কমিশনার এস এন শ্রীবাস্তব ‘সীমান্ত প্রস্তুতি’ স্বচক্ষে দেখেই শুধু যাননি, যথার্থ বলেও দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘২৬ জানুয়ারি থেকে শিক্ষা নিয়েছি। কৃষকেরা যাতে কোনোভাবেই দিল্লি ঢুকতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা পাকা করা হচ্ছে।’ এমন সাজ সাজ রবের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের পিঠে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘২৬ জানুয়ারি পুলিশদের যখন পেটানো হচ্ছিল, তখন তো এসব প্রশ্ন ওঠেনি। আমরা আমাদের প্রতিরোধ জোরালো করছি।’

কিন্তু তাই বলে এভাবে ? নিজের দেশের অন্নদাতাদের বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধ ঘোষণা?

এভাবে ব্যারিকেড তৈরির উদ্দেশ্য একাধিক। প্রথমত, কৃষকদের জন্য সরকার দিল্লি থেকে সব ধরনের সাপ্লাই লাইন কেটে দিতে চাইছে। ব্যারিকেড করা হয়েছে দিল্লি সরকারের পাঠানো ভ্রাম্যমাণ ও অস্থায়ী শৌচাগারগুলো, বাইরে রেখে যাতে কৃষকেরা তা ব্যবহার করতে না পারেন। দিল্লির আম আদমি সরকারসহ সহানুভূতিশীল মানুষজনের পাঠানো পানীয় জলের ট্যাংকার যাতে না পৌঁছতে পারে। শিখ গুরুদ্বারগুলো যাতে লঙ্গরের ব্যবস্থা করতে না পারে।

সাংবাদিকেরাও যাতে অবস্থানস্থলে পৌঁছাতে না পারেন। সাংবাদিকদের ঠেকাতে ধরপাকড়ও হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। খেপিয়ে তোলা। স্থানীয়দের দিয়ে কৃষকদের বিরুদ্ধাচরণ করা। তৃতীয় ও মূল উদ্দেশ্য, কৃষকদের মনোবল ভেঙে দেওয়া, যাতে তাঁরা ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হন অথবা সরকারের শর্তে সমঝোতায় রাজি হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 + eight =