ব্যুরো নিউজ :: সংবাদ প্রবাহ :: কলকাতা :: ১৭৬০ সাল থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত বাংলার সন্ন্যাসী ও ফকিররা ইস্ট কোম্পানির সাথে এক তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলেন, যা ইতিহাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বা ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে কিছু কিছু সংঘর্ষের কথা ইতিহাসে পাওয়া গেলেও কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা ক্রমশ একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই উপস্থিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই বিদ্রোহ ছিল খাজনা আদায়, লুন্ঠন, বাংলার কুটির শিল্প ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের বিরুদ্ধে। বুরহানপন্থী ফকির মজনু শাহ ছিলেন ফকির বিদ্রোহীদের নেতা। মাদারিয়াপন্থী ফকিররাই এই লড়াইয়ের মূল শক্তি ছিলেন। মজনু শাহ-এর অনুগামী হাজার হাজার সন্ন্যাসী ও ফকিরদের প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল উত্তরবঙ্গ। মজনু শাহ-এর সঙ্গে দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠক-দের যোগাযোগ ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। ক্রমাগত লোকক্ষয় ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে।
সমসাময়িক কালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ হল চুয়াড় বিদ্রোহ। মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ধলভূমের জঙ্গলমহলের অধিবাসীরা, কৃষকরা ও অরণ্যবাসী সমাজের নিম্নবর্গ তথা বর্ণের মানুষদের বিদ্রোহ ছিল এটি। অরণ্যের ওপর দীর্ঘদিন ও বংশ-পরম্পরায় ভোগদখলের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে এবং উচ্চহারে খাজনা আদায় করার বিরুদ্ধে চুয়াড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। চুয়াড়দের এই বিদ্রোহের সাথে যোগ দিয়েছিল পাইকরা।
এই সময়েই গড়বেতায় শুরু হয়েছিল লায়েক বিদ্রোহ। ১৮১৬ সালে লায়েক বিদ্রোহ হয়। এখানে লায়েক প্রজারা অচল সিং-এর নেতৃত্বে গেরিলা কায়দায় শালবনীর জঙ্গলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। ১৮১২ সালে ময়মনসিংহে গারো উপজাতির কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে পাগলাপন্থী টিপুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল। এমন কী গারো উপজাতির মানুষরা ১৮২৫ সালে স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
বারাসাত, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, গোবরডাঙা প্রভৃতি স্থানে তিতুমীরের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল কৃষকদের শোষণমুক্তি ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিতুমীরের অনুগামীরা বাঁশের কেল্লার দুর্গ তৈরী করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৮৩১ সালে প্রবল লড়াই চালায়। তিতুমীর ছিলেন ওয়াহাবী সম্প্রদায়ের নেতা। ওয়াহাবী ধর্মপ্রচারক সৈয়দ আহমেদের শিষ্য, যার লক্ষ্য ছিল পুনরায় মুসলমান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
তিতুমীরের মূল লক্ষ্য ছিল প্রচলিত ইসলাম ধর্মের সংস্কারসাধন। কিন্তু কৃষকেরা তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছিলেন বলে জমিদাররা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপন্ন হবার ভয় করছিলেন। তাই তারা তাকে দমন করতে চেয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে কৃষকরা ছিলেন মুসলমান ও জমিদাররা প্রধানত হিন্দু।
তিতুমীরের নেতৃত্বে ২৪ পরগনা ও নদীয়ার লড়াইয়ের পাশাপাশি বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় হাজী শরিয়তউল্লার নেতৃত্বে সেখানকার মুসলমান কৃষকরা জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এক তীব্র লড়াই গড়ে তোলে যা ইতিহাসে ফরাজী আন্দোলন নাম বিখ্যাত।
কৃষক ও কারিগর শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে তিনি ইসলামের সংস্কার আন্দোলনকে পরিচালনা করার উদ্যোগ নেন। অসাধারণ দ্রুত গতিতে তাঁর মতাবলম্বীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ছ’ভাগের এক ভাগ ও ঢাকার এক তৃতীয়াংশ মুসলমান তার অনুসারী হয়ে পড়ে। এই আন্দোলন চলেছিল ১৮৩৮ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত।
এই আন্দোলনেও ধর্মীয় প্রভাব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তার মৃত্যুর পর পুত্র দুদুমিঞার নেতৃত্বে ফরাজী আন্দোলন আরো বিকশিত হয়। শিষ্যদের মধ্যে তিনি সমতার আদর্শ প্রচার করতেন। জমিদারদের অন্যায় খাজনার বিরুদ্ধে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সমস্ত জমির মালিক আল্লা–সুতরাং এতে কারো খাজনা চাইবার অধিকার নেই।
গরীব কৃষক যাদের বেশিরভাগটাই ছিল মুসলমান, তারা ব্যাপকভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। শ্রেণীস্বার্থের বিরোধ ধর্মীয় শত্রুতার রূপ নিয়ে সমাজে উপস্থিত হয়। জমিদার ও নীলকর বনাম কৃষকদের দ্বন্দ্বে ব্রিটিশ সরকার জমিদার-নীলকরদের পক্ষেই দাঁড়াত। কৃষকরা এই ঘটনাকে দেখল হিন্দু বাঙালীর সাথে খ্রিষ্টান ইংরেজদের মৈত্রী হিসেবে। শ্রেণীদ্বন্দ্ব-জনিত লড়াই ‘ধর্মীয় প্রতিরোধ আন্দোলনে’ রূপ পেয়েছিল।