১লা মে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মহান “মে দিবস”

নিউজ ডেস্ক  :: সংবাদ প্রবাহ :: কলকাতা ::  কর্মঘন্টাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার সঙ্গে জড়িত আছে মে দিবসের জন্ম কাহিনী। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এই আন্দোলনের সূচনা। গোড়ার দিকে যদিও মজুরী বাড়ানোর দাবীতেই আন্দোলন শুরু হয়। ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়ায় জুতা শ্রমিকরা যখন ধর্মঘট করে তখন তাদের কর্মঘন্ট ছিল প্রতিদিন প্রায় ২০ ঘন্টা।

১৮২০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কর্মঘন্টা কমাবার জন্য অসংখ্য ধর্মঘট হয়। ১৮২৭ সালে দৈনিক ১০ ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করার দাবীতে মেকানিকদের উদ্যোগে ফিলাডেলফিয়ায় গঠিত হয় বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন। ১৮৬৪ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমজীবী মানুষের প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন ফাস্ট ইন্টারন্যাশনাল। ১৮৬৬ সালে বাল্টিমোরে ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শ্রমিক ফেডারেশন “ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন” যা সে বছরই দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে।

একই বছর ফাস্ট ইন্টার‌্যাশনাল এর জেনেভা কংগ্রেসে ঐ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ১৮৮৪ সালে ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় আন্দোলন। যার সঙ্গে মে দিবসের জন্ম সরাসরি জড়িত। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার ১লা মে তারিখ থেকে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে আন্দোলন গড়ে তোলে।

সে বছর ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে সকল শ্রমিক ধর্মঘট করে নিজ নিজ কারখানা থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। ধর্মঘটের কেন্দ্র ছিল শিকাগো। ১৮৮৬ সালের ১লা মে তারিখে শিকাগোতে শ্রমিকদের এক বিশাল সমাবেশ হয়। আন্দোলনের ডাকে সকল শ্রমিক কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসে। শ্রমিক আন্দোলন ইতিহাসে এর আগে শ্রেণি সংহতি প্রকাশের এত বলিষ্ট প্রকাশ আর দেখা যায় নি। সেদিন ৮ ঘন্টা আন্দোলনের চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে।

৩রা মে শিকাগোর ম্যাককর্মিক ফসল কাটার কারখানায় ধর্মঘটি শ্রমিকদের সমাবেশের উপর পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৪ জন শ্রমিক। পরদিন হে মার্কেটে এর প্রতিবাদে সমাবেশস্থলে অজ্ঞাতনামা কারো বোমার আঘাতে এক পুলিশ সার্জেন্টের মৃত্যু হয়। এরপর লড়াই-সংগ্রামে আরো ৪ জন শ্রমিক আর ৭ জন পুলিশের মৃত্যুতে উন্মাদ হয়ে ওঠে পুলিশ বাহিনী। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হে মার্কেট চত্ত্বর রক্তে রঞ্জিত করে। এরপর প্রহসনের বিচারে ফাঁসির মঞ্চে নির্বিচারে প্রাণ দেয় সংগ্রামী শ্রমিক নেতারা। মে দিবসের আন্দোলনে প্রধান শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ছিলেন আলবার্ট পারসনস্, স্যামুয়েল ফিয়েল্ড, অগাষ্ট স্পাইস, এডলফ ফিশার, মাইকেল শোব, জর্জ এঞ্জেল ও লুুইস লিংগে অন্যতম।

মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির পবিত্র দিবস হিসাবে উন্নীত করার পেছনে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার এর রয়েছে অনন্য অবদান। ১৮৮৮ সালের ১লা মে তারিখ-কে ফেডারেশন ৮ ঘন্টা কাজের আন্দোলনের পুনুরুজ্জীবন দিবস হিসাবে বেছে নেয়। লন্ডন থেকে ফাষ্ট ইন্টারন্যাশনাল সদর দপ্তর নিউইয়র্কে স্থানান্তরিত হবার পর পরিবর্তিত হয়ে এর নাম হয় সেকেন্ড ইন্ট্রারন্যাশনাল, যার প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে।

ঐ কংগ্রেসেই ১লা মে তারিখকে বিশেষ দিবস হিসাবে উদযাপনের জন্য চিহ্নিত করা হয়, যা প্রতি বছরই শ্রমজীবী মানুষের একটি মহান দিবস হিসাবে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।

ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে মে দিবস ::

আমেরিকার শিকাগো শহরের শহীদ শ্রমিকদের অনুপ্রেরনায় ভারতবর্ষেও দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯২০ সালের দিকে রেল, চা বাগান ও ষ্টিমার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংহতি বৃটিশদের কাঁপিয়ে তোলে। পরবর্তীকালে সুতাকল সহ বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিকদের দাবী আদায়ের জন্য সংগঠিত হতে থাকে, ঐ সময় গড়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ মে দিবস পালনের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ঐ সময় অধিকাংশ স্থানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় গোপনে গোপনে মে দিবস পালিত হয়।

১৯২৩ সালে এই উপমহাদেশে প্রথম মে দিবসের অনুষ্ঠান পালন করা হয় মাদ্রাজে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়া। তৎকালীন বাংলার শিল্প কেন্দ্র কলকাতায় সর্বপ্রথম মহান মে দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় ১৯২৭ সালে। একই সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয়। ১৯৩৮ সালে নারায়নগঞ্জে মে দিবস পালনের খবর পাওয়া যায়। দাবী আদায়ের জন্য পরবর্তীতে কোন কোন বছর মে দিবসে ধর্মঘট পালিত হয়। মে দিবসে ছুটি দেওয়ার দাবী উত্থাপিত হয় সর্বত্র। পুরো পাকিস্তান আমলে ঐক্যবদ্ধ ও পৃথক পৃথক ভাবে প্রতিবছর উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে মে দিবস পালিত হয়।

মানুষের দ্বারা মানুষের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রামী সংহতিকে ক্ষুধা, দারিদ্র ও অপমানের হাত থেকে খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি সংগ্রাম কে সামনে রেখে সারা বিশ্বের শ্রমিকরা মহান মে দিবস উদযাপন করে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনে বিপুল শক্তির প্রথম সর্বাত্মক শক্তির সফল প্রতিক মহান মে দিবস। তাই একই সাথে শ্রমজীবী জনগণের ঐক্য, সংহতি সংগ্রাম ও বিজয়ের প্রতীক হিসাবেই তাৎপর্য ও মহিমাপূর্ণ।

মে দিবসে শ্রমিকরা চেয়েছিল নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা যাতে সে বিশ্রামের পর্যাপ্ত সময় পায় এবং মর্যাদাকর মানবিক জীবন যাপন করতে পারে। ১৩৫ বছর পরেও শ্রমজীবী মানুষের এখন প্রধান দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা।
অনেকেই মে দিবসের ছুটি পালন করছেন অথবা তাঁকে আনুষ্ঠানিকতায় বেঁধে তৃপ্তি পাচ্ছেন। তারা হয়তো মে দিবসের তারিখটার খবর রাখেন কিন্তু চেতনার খবর-টা রাখেন না। শ্রমজীবী মানুষ কখনো কখনো কিছুক্ষনের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু সে দাঁড়ানো কোনদিন স্থায়ী হয় না। চাকা ঘোরানো যাদের কাজ তারা দাঁড়ালে ইতিহাস দাঁড়িয়ে যাবে, মহান মে দিবস সে কথাই বলে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × four =