সুদেষ্ণা মন্ডল \ সজল দাশগুপ্ত :: সংবাদ প্রবাহ :: নিউজ ডেস্ক :: বৃহস্পতিবার ৩০,নভেম্বর :: নাম জন হেনরি , সময় ১৮৬৬ সাল। নিউ জার্সির জন হেনরির বয়স আঠারো। পেটাই চেহারার এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ছোট বেলা থেকেই ছিল প্রতিবাদী চরিত্রের। কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শেতাঙ্গদের অত্যচার দেখবার মাত্র গর্জে উঠতেন। নিউ জার্সি শহরের পুলিশ অফিসার চার্লস বার্ড ছিলেন খুব বর্ণবিদ্বেষী, কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অত্যাচার করতেন , যা করে তিনি পাশবিক সুখ পেতেন।
কয়েক ডলার চুরির মিথ্যে অপবাদ দিয়ে প্রতিবাদী জন হেনরিকে ভার্জিনিয়া স্টেট পেনিটেনশিয়ারিতে পাঠালেন অফিসার চার্লস বার্ড। আদালত রায় দিয়েছিল দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।পশ্চিম ভার্জিনিয়ার রেল সুড়ঙ্গে, সেই সময়কালে , আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার পাহাড়ে সুড়ঙ্গ কেটে রেললাইন বসানোর কাজ করছিল একটি কোম্পানি। সেই কাজে অনেকগুলি শক্তিশালী শ্রমিকের দরকার ছিল। জেলের আয় বৃদ্ধি করার জন্য, সুড়ঙ্গ কাটার কাজে কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের শ্রমিকের কাজে পাঠাত জেল কতৃপক্ষ।
প্রত্যেকদিন প্রতি কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক পিছু, জেলের আয় পঁচিশ সেন্ট। তার থেকে মাত্র কয়েক সেন্ট দেওয়া হত শ্রমিকদের।পাহাড়ের স্টিল ড্রিল বসিয়ে কুড়ি পাউন্ড ওজনের একটা হাতুড়ি দিয়ে ড্রিলকে পিটিয়ে পিটিয়ে গর্ত খুঁড়তেন জন হেনরি। গর্তে খুঁড়ে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গর্তটি বড় করা হত,শ্রমিকদের দিয়ে সুড়ঙ্গ কাটাতেন শেতাঙ্গ ঠিকাদারেরা।
অমানুষিক পরিশ্রমের কাজটিও হেনরি করতেন একবারে গলা ছেড়ে , তিনি গান গাইতে গাইতে। তাঁর সজীব উপস্থিতি আরো কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের নিস্প্রাণ জীবনে আনন্দ তুলে ধরতো। সাদা সর্দার কাজ চায় আরও, স্টিম ড্রিল করে আমদানী।উক্ত কোম্পানি আরও তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার জন্য ও শ্রমিক বাবদ খরচ কমাতে সদ্য আবিষ্কৃত স্টিম ড্রিল মেশিন নিয়ে আসে।
এই স্টিম-ড্রিল মেশিন, মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত পাথর কাটতে পারে। কোম্পানির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন চির প্রতিবাদী জন হেনরি। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীরাই শুধুমাত্র সুড়ঙ্গ কাটার কাজ করেন না। উক্ত কাজ করেন হাজার হাজার গরীব কৃষ্ণাঙ্গ নারী পুরুষও। মেশিন এলে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন, এরপর না খেয়ে মরতে হবে ।
কিন্তু তা হতে দেবেন না জন হেনরি।শেতাঙ্গ ঠিকাদারের কাছে গিয়ে মাথা উঁচু করে, বুক চিতিয়ে জন হেনরি বলেন, সুড়ঙ্গ কাটার কাজ করতে মানুষই সেরা, মেশিন নয়। হেনরির কথা শুনে রীতিমত বিদ্রুপ করেন শেতাঙ্গ ঠিকাদার। মেশিনের চেয়ে যে মানুষ বড়, তা হেনরিকেই প্রমাণ করে দেখাতে বলে হয়। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তিনি।
বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নেন, স্টিম ড্রিল মেশিনের সাথে লড়াইয়ে নামেন জন হেনরি। তাঁর প্রিয় হাতুড়িটি নিয়ে। “আমি মেশিনের হবো প্রতিদ্বন্দ্বী, জন হেনরি বলে বুক ঠুকে…।” শপথ নিয়ে ফেলেন জন হেনরি, মেশিনকে পরাজিত করতেই হবে।
তাঁর জেতা কিংবা হারার ওপর নির্ভর হাজার হাজার শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের পেট, ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ। আতঙ্কে শ্রমিকরাও, মেশিনের সাথে মানুষের যুদ্ধে হেনরি হেরে গেলে তাঁদের জীবনে অন্ধকার নামবে।কোনও এক ভোরে, শুরু হয় মানুষের সাথে মেশিনের অসম লড়াই। লুইস টানেলের পাথর খুঁড়ে গভীর থেকে আরও গভীরে যাবার লড়াই করেন একজন হার না মানা মানুষ। অরুণ প্রভাত আনার লড়াই।
বাধার বিন্ধ্যাচল সরানোর লড়াই। টানেলের ডানদিকে পাথর কাটেন হেনরি আর বাঁদিকে পাথর কাটে স্টিম-ড্রিল মেশিন। সুড়ঙ্গের বাইরে গালে হাত দিয়ে বসে তাঁর স্ত্রী মেরি ম্যাকডেলিন। কান পেতে শুনতে থাকেন, সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে ভেসে আসছে হেনরির হাতুড়ির শব্দ ঠক,ঠক,ঠক।পশ্চিম ভার্জিনিয়ার আকাশে সূর্য অস্তমিত।
সূর্যাস্ত হওয়ার আগে পূর্বে দেখা যায় পাথর কেটে টানেলের ১৪ ফুট গভীরে প্রবেশ করেছেন জন হেনরি। অপরদিকে স্টিম ড্রিল মেশিন প্রবেশ করেছে মাত্র ৮ ফুট। এক অদম্য মানুষ ও তাঁর মরণপণ সংগ্রামের কাছে হেরে গিয়েছিল স্ট্রিম ড্রিল। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকের কাছে সম্মানের লড়াইয়ে হেরে শেতাঙ্গ ঠিকাদারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কারণ হেনরির জয় ছিল শেতাঙ্গ প্রভুদের কফিনে নিপিড়িত কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকশ্রেণীর মারা প্রথম পেরেক।
হেনরির জয়ের খবর টানেলের ভেতর থেকে বাইরে আসবার পরেই, আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন টানেলের বাইরে অপেক্ষারত হাজার হাজার কৃষাঙ্গ শ্রমিক। দৌড়ে ভেতরে গিয়ে তাঁরা হেনরিকে কাঁধে করে বাইরে আনার জন্য। গিয়ে দেখেন, বিশ্বের সমস্ত মেহনতি মানুষের রক্ত, ঘাম ও শ্রমের বিজয় পতাকা পশ্চিম ভার্জিনিয়ার আগুন-লাল আকাশে উড়িয়ে দিয়ে ,টানেলের মধ্যেই শেষ ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছেন অপরাজেয় জন হেনরি।
সুড়ঙ্গের বাইরে অপেক্ষায় থাকা মেরি ম্যাকডেলিনের কোলে ছিল হেনরির ছোট্ট মেয়ে। শিশুটিও তখনও জানে না, তার বাবা তাকে ছেড়ে দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে। আজও হেনরির বীর গাথা বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে সিটি দিয়ে চলে যায় ইঞ্জিন।
গতকাল সমগ্র বিশ্ববাসী আবার দেখলো আরও একদল হেনরির অদম্য হাতুড়ির আওয়জের জন্য একচল্লিশ জন হেনরি তাদের নতুন জীবন ফিরে পেলেন ।