“তাঁর অভিনয়ের কদর এই পোড়া দেশে কেউ করেনা , তবে আমেরিকায় জন্মালে উনি নিশ্চিত অস্কার পেতেন”,সত্যজিৎ রায়

সুদেষ্ণা মন্ডল / সজল দাশগুপ্ত  ::  :: নিউজ ডেস্ক   :: মঙ্গলবার ১৯,ডিসেম্বর :: পেট চালাতে রীতিমত সার্কাস দলে কাজ করতে হয়েছে  অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে।  জোকার সাজতেন । পথের পাঁচালি তে প্রসন্ন গুরুমশাই এর চরিত্র করবার  সময় সত্যজিৎ রায়ের নজরে পড়ে যান। এরপরে সত্যজিৎ রায় যখন তাঁকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন “পরশ পাথর” এ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি|
শুটিং এর সময় লোকেশনে তাঁর জন্য গাড়ী পাঠিয়ে দিতেন সত্যজিৎ রায় | দুই দিন যাতায়াতের করবার পর তিনি সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন- এই ট্যাক্সি করে যাতায়াত করতে তিনি পারছেন না। এতে তিনি তাঁর অভিনয়ের স্বত:স্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলছেন। তারপর থেকে  আবার ট্রামেই যাতায়াত শুরু করেন। আজকালকার দিনে, কেউ ভাবতে পারবেন- এই কথা?  তিনি অভিনয় করতেন কোনো মেকআপ ছাড়াই ।
সত্যজিৎ রায় একটি অমোঘ কথা বলেছিলেন তাঁর সম্বন্ধে | একটি সাক্ষাৎকারে  বলেন-” তাঁর অভিনয়ের কদর এই পোড়া দেশে কেউ করে না তবে আমেরিকায় জন্মালে উনি নিশ্চিত অস্কার পেতেন” |  পরশ পাথরের জন্য সত্যজিৎ রায় তাঁকে প্রতিদিন একশো টাকা পারিশ্রমিক এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ।বলেন-” ওরে বাবা আমি এত টাকা পাওয়ার যোগ্য নই.. আর সিনেমা পাড়ায় যদি রটে যায় আমি রোজ একশো টাকা নিচ্ছি আমি আর কাজ পাব না মানিকবাবু |” তিনি বাংলার গর্ব কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী |
প্রবল দারিদ্র্যের সাথে আজীবন লড়াই করে গেছেন কিন্তু তাঁর  মুখের হাসি ছিল অনাবিল | অনুপকুমার কে ছেলে বলতেন তুলসী চক্রবর্তী | প্রবল শীতে একবার অনুপকুমার তুলসী চক্রবর্তী কে একটি সোয়েটার কিনে দিয়েছিলেন।  অনুপকুমার কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী | অভাব থাকবার পরেও অভিনয়ের জন্য নূন্যতম টাকা নিতেন তুলসী চক্রবর্তী।
উত্তমকুমার থেকে সত্যজিৎ, সকলকেই তিনি  টাকা হাতে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘অবাক পৃথিবী’-র সময় একবেলা কাজের জন্য তাঁকে দেওয়া হল তিনশো টাকা। তিনি কিছুতেই তা নেবেন না। কারণ, তখন তাঁর রেট দিনে একশো পঁচিশ টাকা। দলের অনেকের জামা-জুতো ছিঁড়ে গেলে নিজের হাতে সেলাই করে দিতেন তুলসীবাবু। অবসর সময়ে পৌরোহিত্য করে সংসার চালাতেন।
৩ মার্চ, ১৮৯৯ সালে কৃষ্ণনগরের গোয়ারী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। রেলে চাকুরীরত বাবার অকালমৃত্যুর পর মা নিস্তারিণী দেবীকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। তাঁর প্রথম লক্ষ্যই ছিল একটা ভাল চাকরী জোগাড় করা | তিনি
দারুন  গান গাইতে পারতেন, বিশেষ করে কীর্তনাঙ্গের গান। কাকার অর্কেষ্ট্রা পার্টির গ্রুপ ছিল। তুলসী চক্রবর্তীও সেই দলে যোগ দিয়ে কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন।
পরে কাকা স্টার থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পরে  কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে চিৎপুরের এক মদের দোকানে বয়ের কাজ পেয়েছিলেন। কাকা খবর পাওয়ার পরে কাজ ছাড়তে হল। এরপর কাজ নিলেন ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানে বেশিদিন মন টিকল না। বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্মা গিয়েছিলেন।
যে জাহাজে পালালেন সেটিতে বোসেস সার্কাস পার্টিও যাচ্ছিল । সেখানেই চাকরি নিলেন। মাঝে শোয়ের ফাঁকে জোকারও সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্য-কৌতুকের প্রতি ঝোঁকেন।
তুলসী চক্রবর্তী সার্কাসে থেকে কিছু খেলা যেমন শিখলেন তেমনি শিখলেন উর্দু ও হিন্দী বলতে। সার্কাসে তিনি ছয় মাস কাজ করেছিলেন।এরপর  চলে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলে ছিলেন- ‘শরীর থেকে জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ বেরচ্ছে দেখে চলে এলুম।’ কাকা তখন তাঁকে ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ জুটিয়ে দিলেন। সেখানে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপা হত। তা দেখবার পর তার অভিনেতা হতে ইচ্ছে করল।
জ্যাঠামশায়কে অনেক অনুরোধ করবার পর তিনি স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে ঢোকালেন। সে সময় প্রেসে তাঁর মাইনে ছিল ৩২ টাকা। স্টারে এলেন ৮ টাকার মাইনেতে! তৎকালীন ষ্টার থিয়েটারের মালিক ছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চোখে পড়ে যান অপরেশবাবুর।
এই অপরেশবাবুই তালিম দেন তুলসী চক্রবর্তীকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো- সব শিখেছিলেন। ১৯২০ সালে প্রথম ষ্টেজে অভিনয় করেছিলেন। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি ষ্টার থিয়েটারেই ছিলেন। এরপরে তিনি যোগ দেন, মনমোহন থিয়েটারে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত অন্তত ৪২টা নাটকে অভিনয় করেন।
তুলসী চক্রবর্তীর সিনেমা শুরু  হয় ১৯৩২ সালে, নিউ থিয়েটারের ‘পুনর্জন্ম’ সিনেমায়। তাঁর শেষ সিনেমা মৃত্যুর আঠারো বছর পর মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে ‘আমি রতন’। সারাজীবনে  মোট ৩১৬ টি বাংলা ও ২৩ টি হিন্দী সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, তবে  দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ১১ ডিসেম্বর ১৯৬১ তে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । টাকা ছিল না চিকিৎসার জন্য।
প্রচণ্ড দারিদ্রতা তো ছিলই, তার ওপরে নিজের বাড়ীটা দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য।  এরপর তাঁর স্ত্রী উষারাণী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্রের কারণে স্বামীর সব  মেডেল বিক্রী করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। মারা যাবার পর সরকারের তরফ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনওরকম বন্দোবস্ত ছিল না তখন। অবশ্য তাতে কিছুই আসে যায় না। তিনি আছেন আর থাকবেন বাঙালির অন্তরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten + twelve =