জয়নগরের দত্ত বাড়িতে দুর্গা পুজোয় আসতেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

সুদেষ্ণা মন্ডল  :: সংবাদ প্রবাহ :: জয়নগর :: বুবুধবার ২৫,সেপ্টেম্বর :: দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত অন্যতম প্রাচীন পৌর শহর জয়নগরকে আমরা সকলেই চিনি সুপ্রসিদ্ধ মোয়া প্রস্তুতকারীর কেন্দ্র হিসেবে। তবে, জয়নগরের মোয়া যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই জয়নগর অঞ্চলের ইতিহাসও একইরকম ভাবে সুপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। আদি গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহ পথে সুন্দরবনের অন্তগর্ত, এই অঞ্চল গড়ে উঠেছে পাশাপাশি দুটি এলাকা জুড়ে।যার একটি হল জয়নগর, ওপরটি মজিলপুর।

জয়নগরের কিছু ঐতিহাসিক বনেদী বাড়ি এখনো তাদের ইতিহাসকে আগলে ধরে বেঁচে রয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বেশ কয়েকটি প্রাচীন বনেদি বাড়ি দুর্গাপূজার মধ্যে অন্যতম হল জয়নগরের দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো। অনেকেই আবার এই দত্তবাড়ির দুর্গাপূজাকে সাদা দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো বলে অনেকেই ডেকে থাকে। ১৬৭৫ সালে জমিদার রামচন্দ্র দত্ত কলিকাতা থেকে সুন্দরবনে এসে নিজের জমিদারি আধিপত্য স্থাপন করে।

এরপর মা দুর্গার স্বপ্নাদেশে শুরু হয় দুর্গাপুজো। তৎকালীন রামচন্দ্র দত্ত তার জমিদারি আধিপত্য এতটাই বিস্তার ছিল যে ৯৪ টি মৌজা এবং ৬ টি থানার জুড়ে তার জমিদারি আধিপত্য ছিল। দশ দিন ধরে এই দত্তবাড়িতে মহা কর্মযজ্ঞের অনুষ্ঠান লেগে থাকত অতীতে। মহালয় এর পরের দিন অর্থাৎ প্রথম থেকেই শুরু হতো দেবীর বোধন এরপর টানা ১০ দিন দেবীর পূজার শুরুর সময় বন্ধুকে আওয়াজ করে পূজোয় বসতেন পুরোহিতরা।

কালের নিয়মে জমিদারি প্রথা আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে জমিদারি কিছু দুর্গাপূজা। জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে গেলেও এখনও রয়ে গেছে সেই প্রাচীন রীতিনীতি। এখনো এই দত্তবাড়িতে টানা ১০ দিন ধরে দেবীর আরাধনা করা হয়। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতানুসারে এখানে পূজিত হন দেবী দুর্গা।

পরিবারের সদস্যরা কর্মসূত্রে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে থাকলেও পুজোর সময় পরিবারের সকল সদস্যরা এসে উপস্থিত হয় এই দত্তবাড়িতে। অতীতের সেই জৌলস কিছুটা ভাটা পড়লেও এখনো পর্যন্ত সেই প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলছে দত্ত বাড়ির সদস্যরা।

এখনো প্ৰথা মেনেই রথযাত্রার দিন কাঠামো পূজা হয় বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পী, পুরোহিত ও বাদ্যকাররা এই বাড়িতে পূজোয় সামিল হন। বলিদান প্রথা এখনও রয়েছে এই দত্তবাড়িতে পুজোর শুরু হওয়ার আগে এখন আর বন্দুকের আওয়াজ হয় না বরং আতশবাজি জ্বালিয়ে পুজো শুরু করা হয়। দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো এ বছর ৩৪৯ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে।

এই দত্তবাড়িতে বারুইপুরের ম্যাজিস্ট্রেট থাকা কালীন দত্তবাড়িতে আনাগোনা ছিল সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি দত্ত বাড়িতে প্রায় সময় এসে ছুটি কাটাতেন এবং দত্ত বাড়ির দুর্গা পুজোয় তিনি সামিল হতেন। জয়নগরের এই দত্তবাড়িতে বসে তিনি লিখেছিলেন বিষবৃক্ষ উপন্যাস। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি উপন্যাসে এই দত্ত বাড়ির উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে পরিবারের এক সদস্য শিবেন্দ্র নারায়ন দত্ত তিনি বলেন, কর্মসূত্রে কলকাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় পরিবারের সদস্যরা থাকলেও পুজোর সময় তারা এই দত্ত বাড়িতে এসে উপস্থিত হন এবং প্রাচীন যে প্রথা সেই প্রথা মেনেই এখনো পর্যন্ত ১০ দিনের দুর্গাপূজা আমরা করে থাকি।

এই পূজোর সঙ্গে বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে তৎকালীন বারুইপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দত্ত বাড়ির ছেলে যোগেন্দ্র নারায়ন দত্তের বাল্যবন্ধু হওয়ার সুবাদে। দত্ত বাড়িতে তার আনাগোনা ছিল ছুটির দিনগুলিতে দত্ত বাড়িতেই আসতেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এমনকি দুর্গা পুজোতে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তিনি এই দত্তবাড়িতে এসে দুর্গাপুজো উপভোগ করতেন।

এই দত্তবাড়ির সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্রর নিবিড় টান রয়েছে। দত্ত বাড়ি স্থানে নেতাজি সুভাষচন্দ্রর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক থাকাকালীন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বাধীনতা আন্দোলনে বেশ কয়েকটি সভা এই দত্ত বাড়ির সামনের মাঠেই করেছে। এখনো পর্যন্ত নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের বাড়িতে দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রসাদ পাঠানো হয়। দত্ত বাড়ির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বহু ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 1 =