আনন্দ মুখোপাধ্যায় :: সংবাদ প্রবাহ নিউজ ডেস্ক :: ৮ই,জানুয়ারি :: কলকাতা :: আত্মজীবনীর চতুর্থ ও শেষ খণ্ড দ্য প্রেসিডেনশিয়াল ইয়ার্স: ২০১২-২০১৭ তে মোদির সমালোচনা করেছেন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। গত মঙ্গলবার বইটি প্রকাশিত হয়েছে।বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে যে একেবারেই চাঁচাছোলা ভাষায় প্রণব বাবু ভারতীয় রাজনীতিকদের সমালোচনা করেছেন কোনোরকম রাখঢাক না করেই । যেমন বইটির এক জায়গায় লিখেছেন রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার জন্যই কংগ্রেস পার্টি কিছুটা পিছিয়েছে ।একটা কথা ঠিকই যে রাজনীতিতে রাহুল গান্ধীর বয়সটাও কিন্তু গ্রাহ্যের মধ্যে আনতে হবে ।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদী কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দিক থেকেই বেশ কিছু একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।যেমন পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে তিনি যে ভাবে তিনি তার রাজনীতিকরণ করেছিলেন তাতে কিন্তু প্রাজ্ঞ ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারের ভ্রূকুঞ্চন করে ছিলেন । আমরা দেখবো এই বিষয়ে প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভাবনা কি ছিল । তিনি লিখছেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়েও মোদি বাড়াবাড়ি করেছিলেন । কারণ, তাঁর মতে, ‘পাকিস্তানি আগ্রাসনের জবাবে সীমান্তে এমন ঘটনা আকছার ঘটে। ভারতীয় সেনা এমন ধরনের হামলা প্রায়ই চালিয়ে থাকে। এতটা বাড়াবাড়ি তাই না করলেও চলত। এতে ভারতের কোনো লাভ হয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিদেশ নীতিও কিন্তু সমালোচনার উর্ধে নয় । অত্যন্ত প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক প্রণব মুখোপাধ্যায় কিন্তু এই বিষয়ে তাঁর বই “মাই প্রেডিনেশিয়াল ইয়ার্স” এ দীর্ঘ সমালোচনা করেছেন । তাঁর মতে মোদির যে বিদেশী রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে বন্ধুত্ব করার ভাবনাএটা কিন্তু আন্তর্জাতিক বিদেশ নীতির সঙ্গে মোটেই খাপ খায়না । এবিষয়ে তাঁর ভাবনা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ব্যক্তিগত রসায়নকে মোদি বরাবর গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। সম্পর্ককে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। ব্যক্তিগত সখ্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপনের এই প্রচেষ্টা প্রণব অনুমোদন করেননি। মোদিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ‘ভরসাযোগ্য বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তার উল্লেখ করে প্রণব লিখেছেন, ‘আমি রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের বিরোধী। কারণ, তা কূটনৈতিক সম্পর্কের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এই বন্ধুত্বের কোনো গুরুত্ব নেই। কূটনীতিতে কোনো সম্পর্কই ব্যক্তিগত হয় না।’
এই প্রসঙ্গে প্রণব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর পারিবারিক রসায়নের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বও পুরোপুরি রাজনৈতিক। অবশ্যই শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তখন তিনি ভারতে ছিলেন। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি ব্যক্তিগত (বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে) সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন। এ ধরনের সম্পর্ককে সত্যিকারের বন্ধুত্ব ভেবে নেওয়া ভুল ও অযৌক্তিক।’
মোদির অনভিজ্ঞতা এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন প্রণব। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বার কয়েক বিদেশ ভ্রমণ করলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতির মতে, অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক নীতি নিয়ে বিশেষ ধারণা ছিল না। অনভিজ্ঞই ছিলেন। সেই কারণে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একের পর এক যে ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অতীতে আর কেউ তেমন করেননি। ফলে সমালোচিতও হয়েছেন। প্রণবের মতে, অনভিজ্ঞতার দরুন প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রথমবারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরিফ সহ সার্ক সদস্যদেশের রাষ্ট্রনেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপারেও প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন । পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে মোদিকে সম্পর্ক গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রণব। লিখেছেন, ‘ইমরান স্বাধীনতার পরে জন্মেছেন। তিনি নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক। স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে মুসলিম লিগ যে ধরনের রাজনীতি করত, তার কোনো দায় ইমরান খানের নেই।’ প্রণব লিখেছেন, ‘ভারত সম্পর্কে ইমরানের অবস্থান কী, সে বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, ইমরানের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।’
মোদির কাজ করার ধরন তাঁর ‘স্বৈরতন্ত্রী’ বলে মনে হয়েছে। সেই কারণে তাঁকে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন। বলেছেন, বিরোধীদের হেলাফেলা না করে তাঁদের কথা বেশি করে শোনা উচিত। সংসদে আরও বেশি করে তাঁর উপস্থিত থাকা দরকার। সংসদ সুষ্ঠুভাবে চালনার প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে মোদির ব্যর্থতার উল্লেখ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি লিখেছেন, সংসদকে ব্যবহার করে বিরোধীদের সন্তুষ্ট করার মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছে তিনি সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে পারেন। এই ফোরামকে ব্যবহার করা প্রয়োজন।
ইউপিএ (সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা) আমলে এই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, সব সময় তিনি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বিভিন্ন বিষয়ে ইউপিএ ও এনডিএ (জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট) দুই শিবিরের অভিজ্ঞ নেতাদের মতামত নিতেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি আগে বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্থিতিশীলতা দেয় ঠিকই, কিন্তু কাজ করতে হয় সবার সঙ্গে মিলেমিশে। সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মই তা। এর উল্টো পথের পথিকদের ভোটাররা শাস্তি দিয়েছেন।’
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের “দ্য প্রেসিডেন্সিয়াল ইয়ার্স” বইটি প্রকাশিত হবার পর আমরা জানতে পারছি যে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মত একজন প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কে পাশে পেয়েও মোদীজি তাঁকে ভারতের আরও উন্নতির জন্য সবটুকু কাজে লাগাতে পারেননি ইটা কিন্তু ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য ।