BREAKING NEWS :: বিজেপি কি কফি হাউসের আদর্শিক দখল চায় ?

আনন্দ মুখোপাধ্যায় :: সংবাদপ্রবাহ :: ১৯শে,মার্চ :: কলকাতা ::  কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট `কফি হাউস’ মুক্তচিন্তার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বিজেপি কফি হাউসের আদর্শকে জোর করে দখল করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ এসেছে। বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এই অভিযোগ আনা হলো। সোমবার সন্ধ্যায় একদল বিজেপি কর্মী গেরুয়া টি-শার্ট পরে সদলবলে কফি হাউসে যাওয়ার পর এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। সেখানে তারা বিজেপি-বিরোধী পোস্টার সরাতে শুরু করলে বিপক্ষের সাথে তুমুল সংঘাতের সৃষ্টি হয়।

এই ঘটনার পর বিজেপি নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, তারা কফি হাউসে গেলে অসুবিধা কোথায়? বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো বলছেন, কফি হাউসে বিজেপির আধিপত্যবাদী সংস্কৃতিকে কিছুতেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। বস্তুত কলকাতায় প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো কফি হাউস বরাবরই প্রগতিশীল ও কিছুটা বাম-ঘেষা চিন্তাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। শহরে ভোটের প্রচার যখন তুঙ্গে, তখন সোমবার সন্ধ্যায় একদল বিজেপি কর্মী সেখানে হাজির হলে অনেকেই চমকে যান। একটু পরেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।

কফি হাউসে ওঠার সিঁড়িতে `বিজেপিকে ভোট নয়’ লেখা পোস্টার লাগায় `বেঙ্গল এগেইনস্ট ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি’ নামে একটি সংগঠন। তাদের সদস্য শ্রেয়া আচার্জি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, ওদের প্রত্যেকের গায়ে ছিল `মোদি-পাড়া’ লেখা টি-শার্ট। গেরুয়া রঙের টি-শার্টগুলোতে মোদির ছবি ছিল। যারা এসেছিল তাদের সবার গায়েই ছিল একই টি-শার্ট।

সন্ধ্যাবেলা ওভাবেই ওরা কফি হাউসে ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন টেবিল দখল করে বসে পড়ে। ওরা একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করে। লোকজন প্রথমে বুঝেই উঠতে পারেনি ঠিক কী চলছে। কফি হাউসে কেউ এরকম দৃশ্য দেখতেই অভ্যস্ত নয়। আমরা এর আগে গোটা রাজ্য জুড়েই বিজেপিকে একটিও ভোট নয় ক্যাম্পেইন চালাচ্ছিলাম। সেই পোস্টারিং করা হয়েছিল কফি হাউসে। যা ওরা ছিঁড়ে দেয়, পোস্টারে কালি লেপে দেয়।

দলীয় কর্মীদের নিয়ে দিল্লির যে বিজেপি নেতা তেজিন্দর সিং বাগ্গা কফি হাউসে গিয়েছিলেন। তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা আবার অন্যরকম। তিনি বলেন, সেদিন প্রচারের পর কর্মীরা বললেন চলুন কফি হাউসে গিয়ে বসা যাক। তো আমরা চল্লিশ কি পঞ্চাশজন মিলে বিকেল পাঁচটার দিকে গেলাম। পৌনে সাতটা অবধি বসে কফিও খেলাম। যখন ওঠে আসছি তখন একজন কর্মী সিঁড়িতে `নো ভোট টু বিজেপি’ লেখা পোস্টার দেখতে পেয়ে সেই ‘নো’ টা মুছে দিয়েছিলেন।

সাথে সাথে বামপন্থী কর্মীরা এসে আমাদের ওপর চড়াও হন, স্লোগান দিতে শুরু করেন। তবে যা হয়েছে সব সিঁড়িতে ও রাস্তায়। কফি হাউসের ভেতর কিছু হয়নি। আমার বক্তব্য, কফি হাউসে গিয়ে আমাদের এক কাপ কফি খাওয়াকে যারা সহ্য করতে পারেন না তারা কীভাবে অপরকে অসহিষ্ণুতার কথা বলেন?।

কলকাতার অগ্রগণ্য কবি ও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের ঘনিষ্ঠ সুবোধ সরকার কফি হাউসে যাচ্ছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। তিনি এই ঘটনাকে স্রেফ বিজেপি নেতাদের কফিতে চুমুক দিতে যাওয়ার মতো নিরীহ পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে রাজি নন।

সুবোধ সরকার বলছিলেন, কফি হাউস আসলে বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও নব্য সিনেমার একটি প্রতীক। এখানে বিভিন্ন চিন্তার স্রোত এসে মিশেছে। এখানে যেমন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন আসতেন, তেমনি আড্ডা দিতে বসতেন কমলকুমার মজুমদার কিংবা সুনীল-শক্তিরাও। সত্তর দশকের দামাল দিনগুলোতেও দেখেছি সেখানে সবাইকে আসতে। সেখানে এমন অসভ্যতা কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে কখনো দেখব ভাবিনি।

নকশাল আমলে যখন চারপাশে ভাঙচুর চলছে, তখনো কিন্তু এই কফি হাউসের একটি চেয়ারও ভাঙা হয়নি। আজকে কফি হাউসে দাঁড়িয়ে এরা যা করলেন, ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হল, আমার ধারণা সেটা শুধু অসভ্যতা নয় এটা আসলে একটা বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশ। আর সেটা হল বাঙালি সংস্কৃতির সব ঐতিহ্যশালী, মননশীল প্রতিষ্ঠানগুলো কেড়ে নিতে হবে। এবং এটা উত্তরপ্রদেশ থেকে আমদানি করা একটা হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু বিজেপি যে পাল্টা অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলছে, রাজ্যে তাদের বিপক্ষ শক্তি তার জবাবে কী বলছে?

যে ফোরাম কফি হাউসের নিচে বিজেপি-বিরোধী পোস্টার লাগিয়েছিল, তার নেতৃস্থানীয় শ্রেয়া আচার্যি সরাসরি বলছেন, বিজেপির আদর্শটাই আসলে কফি হাউসের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। তিনি বলছেন, মুক্তচিন্তা বা গণতন্ত্র চর্চার যে পরিসর, বিজেপি তো তাতে বিশ্বাসই করে না। দেখুন, কারো গণতান্ত্রিক অধিকার তো সীমাহীন হতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, এই বিজেপি ধর্ষণকারীদের সমর্থনে পর্যন্ত মিছিল করেছে। এখন কেউ যদি বলে সেটাও আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। ফলে সেই জায়গা থেকে আজ কলেজ স্ট্রীট-বইপাড়া-কফি হাউসে যে মুক্তচিন্তা রয়েছে, বিজেপি তা ভাঙতে চাইলে তার উল্টোদিকেও একইভাবে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আছে।

পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচন অনেকটাই বাঙালি বনাম অবাঙালির সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের চেহারা পেয়েছে, কোনো দল রাজ্যের প্রকৃত সংস্কৃতির প্রতিনিধি তা নিয়েও চলছে বিতর্ক। আর সেই আবহেই সবশেষ সংযোজন কফি হাউসকে ঘিরে এই ঘটনা যেখানে আইকনিক কালো কফি বা ‘ইনফিউশনে’ চুমুক দেয়া এখনো বাঙালি বুদ্ধিজীবীর পরিচিতি হিসেবেই গণ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *